ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: সিন্ডিকেট করে প্রতিটি ডিমের দাম এক রাতে তিন টাকা বাড়লেও দাম বৃদ্ধির দায় নিতে চাচ্ছে না এ খাতের কেউ। ডিমের দাম যেন হাওয়াতে বেড়েছে। এ খাতের খামারি, ফার্ম ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ডিলার, আড়তদার, পাইকারী ব্যবসায়ী এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ দায় স্বীকার করছে না।
বুধবার (২৪ আগস্ট) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে উৎপাদনকারী ফার্ম ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান, এজেন্ট, ডিলার ও ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
মতবিনিময় সভায় কেউ ডিমের দাম বৃদ্ধির দায় স্বীকার করেননি। নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজিও তাদের ব্যাখ্যার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সমাধান আসেনি।
এর আগে গত সোমবার ডিমের আড়তদার, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হয়েছি। সেই সভাতেও ডিমের দাম বৃদ্ধির দায় কেউ নেয়নি। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে, কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সভা।
তবে আজকের মতবিনিময় সভা শেষে অধিদপ্তরের ডিজি সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বৈঠক ও অভিযানের মাধ্যমে আমরা যেসব তথ্য পেয়েছি, সেগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবো। এরপর যথাযথ কর্তৃপক্ষ এর ব্যবস্থা নেবেন। বিগত সময় তেল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবেদন সাপেক্ষে প্রতিযোগিতা কমিশন বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে আটটি মামলা করেছে।’
ডিম সিন্ডিকেট নিয়ে ভোক্তার ডিজি বলেন, ‘ডিম নিয়ে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। এর পেছনে কে বা কারা আছেন, সেটা খুঁজে বের করবো। এ কালোহাত যেন আর কখনো না বাড়তে পারে, সেই ব্যবস্থাও নেবো।’
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘যখন জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তখন একটি ডিমে ২০-৩০ পয়সা খরচ বেড়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম এক রাতে তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। এটা একদম অস্বাভাবিক। আপনারা বলতে পারবেন না যে, সিন্ডিকেট করেননি।’
ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন দিকে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। এখন যদি আমদানি ওপেন করে দেওয়া হয়, অনেকে পথে বসবেন। কিন্তু আপনারা সিন্ডিকেট করছেন। সেজন্য জনগণের কাছে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কোম্পানি ডিমের দাম অবৈধভাবে বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে। আড়তদাররাও করেছেন। কেউ বলেছেন, দাম নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের যে নেই, সেটা তারা জানতেন না। আইন না জানলে ব্যবসা করার দরকার নেই।’
এসময় কাজী ফার্মের প্রসঙ্গ টেনে মহাপরিচালক বলেন, পরিবহন সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিনে তাদের ডিমের দাম তিন টাকা বেড়েছে। এ বাড়তি দামে কাজী ফার্মের যে দরদাতা, সেই ফয়সালকে আজ উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। তিনি আসেননি। নাকি তাকে আসতে দেওয়া হয়নি? এরমধ্যেও অদৃশ্য হাত আছে। সেটা চিহ্নিত করতে বসেছি।’
ডিমের দামের কারসাজির তথ্য খুঁজে বের করতে সাভারে কাজী ফার্মের আঞ্চলিক ডিপোতে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। প্রথম দফায় (২০ আগস্ট) ডিমের দাম বাড়ানো নিয়ে কারসাজির অভিযোগে সাভারে আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ফয়সাল সরকারের ‘ফয়সাল এন্টারপ্রাইজকে’ আড়াই লাখ টাকা জরিমানাসহ সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে সংস্থাটি।
ফয়সাল এন্টারপ্রাইজ কাজী ফার্মের বিক্রয়কেন্দ্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে আসছে। সিন্ডিকেটের পেছনে কোম্পানি ও তার হাত রয়েছে বলে একাধিকবার দাবি করেছে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে, শেষ দফায় মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) সাভারে কাজী ফার্মের অভিযানের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে আজকের সভায় অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আপনাদের তথ্য ঠিক নেই। কাজী ফার্ম অফার প্রাইজে একবারে দুই টাকা ১৫ পয়সা বাড়িয়েছে ১৩ আগস্ট রাতে। যে ফয়সাল অন্য সময়ে সর্বোচ্চ দেড় লাখ ডিম কিনতেন, তিনি সেদিন বেশি দামে দুই লাখ ৯ হাজার ডিম কিনেছেন কেন? সেটার কোনো রশিদ নেই, কাগজও নেই।’
আব্দুল জব্বার বলেন, ‘কাজী ফার্মে ১০৮ জন এজেন্ট। কমপক্ষে ১০ জনকে আসতে বলা হয়েছে। তারা কাল রাতেও বলেছেন আসবেন। আজ একজনও এলেন না কেন?’
জবাবে কাজী ফার্মস গ্রুপে ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, ‘আমরা যে ডিমের অফার প্রাইজ দেই, সেটি নির্ধারিত নয়। তার থেকে কম দামেও বিক্রি হয়। সেসময় যিনি অস্বাভাবিক বিট দেন, তিনি ট্রেডার্স। সেটা তার ব্যাপার। আমরা চায় বড় ট্রেডার্স আমাদের ডিম কিনুক। তাতে খরচ ও ঝামেলা কম। কিন্তু একদিনে ফয়সাল দুই টাকা বেশি দামে ডিম কিনেছেন। সেজন্য ডিমের দাম অস্থিতিশীল হয়েছে, এটা ঠিক না।’
জাহেদুল হাসান বলেন, ‘আপনাদের (ভোক্তা অধিদপ্তরের) কর্মকাণ্ডে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ভয় পাচ্ছি। এ খাতের ক্ষতি হবে। আপনাদের অভিযানের কারণে আমাদের কনফিডেনসিয়াল তথ্য মিডিয়ার সামনে আসলো। আবার ফয়সালকে ভুল ধারায় মামলা করলেন। তার চারটি মামলার সবগুলো ভুল ধারায়। আমরা যে মাসের পর মাস লস করেছি, সেটা আপনারা দেখেননি।’
এসময় তার কথার প্রসঙ্গ টেনে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সব ব্যবসায়ী শুধু লস করে। কাউকে কখনো লাভ করতে শুনিনি। যেন আপনারা শুধু মানবসেবায় করে যাচ্ছেন।’
অন্যদিকে আফতাব গ্রুপের প্রতিনিধি ফজলে রহিম খান বলেন, ‘সত্যি এ পরিস্থিতিতে আমরা ভয় পেয়ে যাচ্ছি। কাল কী হবে? হাজার হাজার কোটি টাকা ইনভেস্টমেন্ট এ খাতে। সে বিষয়টি অবশ্যই দেখতে হবে।’
এরপর ভোক্তার ডিজি সফিকুজ্জামান বলেন, ‘দু-একজন ব্যবসায়ীর জন্য পুরো খাত ভুগবে, সেটা আমরা হতে দেবো না। ডিম নিয়ে এমন অস্বাভাবিক ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া হবে না। এটা আমরা ফাইন্ড আউট করবো। এমন নির্দেশনাও ওপর মহল থেকে আছে। এবার ছাড়বো না।’